পাঠকেরা চটুল বইয়ের পরিবর্তে গবেষণাধর্মী মননশীল বই পড়তে আগ্রহী হয়েছেন বলে মন্তব্য করেছেন লেখক ও অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল। এটা খুবই আনন্দের বিষয় বলেছেন তিনি।
নিজের অভিজ্ঞতা জানিয়ে আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা বলেছেন, অনেক সময় ইচ্ছা থাকলেও অনেক কিছু স্পষ্ট করে লিখতে পারেননি। অনেক রকম চাপ এসেছে তবে তা সত্ত্বেও তিনি তাঁর লেখা অব্যাহত রেখেছেন।
গতকাল শুক্রবার প্রথমা প্রকাশন আয়োজিত বিজয় বইমেলা মঞ্চে নিজের লেখালেখি নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে আসিফ নজরুল বলেন, ছাত্র জীবন থেকেই তিনি লেখালেখি শুরু করেছিলেন। ১৯৯২ সালে তার প্রথম উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছিল। মাঝখানে পিএইচডি গবেষণার জন্য বিদেশে থাকায় অনেক দিন বই লিখতে পারেননি।
উপন্যাস,গবেষণাসহ সব মিলিয়ে বইয়ের সংখ্যা ২৫টি। এর মধ্যে প্রথমা থেকেই প্রকাশিত হয়েছে ১০টি। একজন লেখকের জন্য তাঁর বই নিয়ে এমন আলোচনা খুবই আনন্দের। সে কারণে এই আয়োজনের জন্য তিনি আনন্দিত।
আসিফ নজরুল বলেন, গত দুই বছর তার লেখক জীবনের বিশেষ উল্লেখযোগ্য সময় কেটেছে। ‘সংবিধান বিতর্ক: ১৯৭২ গণ পরিষদের রাষ্ট্র ভাবনা’ তার পিএইচডি গবেষণার থিসিস নিয়ে বই প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় ও ছাত্ররাজনীতির কেন্দ্রিক ‘আমি আবু বকর’নামের উপন্যাসটিও পাঠক প্রিয় হয়েছে। বিশেষ করে গণপরিষদ বিতর্ক বইটিতে সংবিধান রচনা নিয়ে তখন গণপরিষদে যেসব আলোচনা হয়েছিল সেই সব তথ্য উপাত্ত এবং অনেক বিষয় তুলে এনেছেন যা আগে কোনো বইতে ছিল না। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘যেমন আমাদের সংবিধানে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ বিষয়টি কীভাবে সংযোজিত হয়েছিল? এটা বেশ রহস্যময়। কারণ এর আগে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতার বিষয়টি ছিল না। ভারতের সংবিধানে এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার কোনো দেশের সংবিধানে ‘ধর্মনিরপেক্ষতার বিষয়টি নেই। অনেক গবেষণা করে বইটি লেখা।’ তিনি বলেন, অনেক তথ্য তিনি পেয়েছিলেন, তার সবকিছু স্পষ্ট করে বলতে পারেননি। তবে সেসবের ইঙ্গিত দিয়েছেন, যা মনোযোগী পাঠকেরা বুঝতে পারবেন। এসব গবেষণা ধর্মী বই বেশ বিক্রি হয়েছে। এ থেকেই বোঝা যায় মননশীল বইয়ের পাঠক বাড়ছে।
আসিফ নজরুলের বই নিয়ে আলোচনায় বদিউল আলম মজুমদার বলেন, সংবিধান নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। গণ-অভ্যুত্থানের পরে সংবিধান নতুন করে লেখা হবে না সংস্কার করা হবে এই নিয়ে আলোচনা চলছে। সারা দেশের মানুষের মধ্যেও আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। এটা ভালো লক্ষণ। নাগরিক সচেতনতা যত বৃদ্ধি পাবে, গণতন্ত্রও তত বিকশিত হয়। আসিফ নজরুল তার গবেষণামূলক গণপরিষদ বিতর্ক বইটিতে গণপরিষদ সঠিক ভাবে গঠিত হয়েছিল কিনা, যাদের নিয়ে গঠিত হয়েছিল তারা যথাযথ ভাবে আলোচনা করেছিলেন কিনা, কোনো বিশেষজ্ঞের সঙ্গে তারা আলোচনা করেছিলেন কিনা, মৌলিক অধিকার প্রশ্নে তারা কী কী সুপারিশ করেছিলেন এমন অনেক বিষয় তুলে ধরেছেন। এই বিষয়গুলো এখন সংবিধান সংস্কার বা পুনর্লিখন যাই করা হোক তাতে সহায়তা করতে পারে।
আইনের ইতিহাস বিষয়ক তরুণ গবেষক রাশেদ রাহম আলোচনায় বলেন , আসিফ নজরুল তার বইটিতে গণতান্ত্রিক সমাজ গঠনের জন্য সংবিধানের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করেছেন। তবে আমাদের এখানে স্বাধীনতা নিয়ে যে এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক বয়ান তৈরি করা হয়েছে সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। কারণ এক ব্যক্তির ইতিহাস একটি জাতির ইতিহাস হতে পারে না। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পরে ইতিহাসের এই একদেশদর্শিতা ত্যাগ করে বড় পরিসরে জাতির ইতিহাস পর্যবেক্ষণের সুযোগ তৈরি হয়েছে।
প্রথমার প্রধান সমন্বয়ক ও লেখক মসিউল আলম বলেন, আফিস নজরুলের লেখালেখির দুটি আলাদা ধারা রয়েছে। তিনি উপন্যাস দিয়ে লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন। পরে আইন ও রাজনীতি বিষয়ে গবেষণা মূলক বই সংবাদপত্রে নিয়মিত কলাম লিখেছেন। তবে তিনি তার উপন্যাস ও অন্যান্য রচনায় সব সময় সমকালীন ঘটনাকে প্রাধান্য দিয়েছেন এটি তার বিশেষ বৈশিষ্ট্য।
আলোচনার পরে ‘ভুলে যাই আমি/ভুলে যাও তুমি’ এবং ‘কি বলার কথা কি বলছি’ গান দুটি গেয়ে শোনান পারসা মেহজাবীন। সঞ্চালনা করেন শিশু সাহিত্যিক সাইদুজ্জামান রওশন।
গত ১২ ডিসেম্বর থেকে বাংলা একাডেমি চত্বরে প্রথমা প্রকাশনের আয়োজনে শুরু হয়েছে দশ দিনের বিজয় বইমেলা। আজ সমাপনী দিনে সকাল ১১টা থেকে রাত আটটা অবদি মেলা খোলা থাকবে। মেলার পৃষ্ঠপোষকতা করছে এইচএসবিসি ব্যাংক।
বইমেলায় প্রথমা প্রকাশনে বই ৩০ থেকে সর্বোচ্চ ৭০ শতাংশ, অন্য প্রকাশনীর বই ২৫ শতাংশ এবং বিদেশি বই সর্বনিম্ন ৫ থেকে সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ ছাড়ে কেনা যাবে।
আজকের অনুষ্ঠান: আজ প্রথমার বিজয় বইমেলার সমাপনী দিন। মেলামঞ্চে আলোচনার বিষয় ‘দেশ,মানুষ,লেখালেখি’। বিকেল চারটায় সমাপনী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন কথাশিল্পী হাসনাত আবদুল হাই। আলোচনা করবেন অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, বিশ্বজিৎ চৌধুরী ও উম্মে ফারহানা। গান শোনাবেন ওয়ার্দা আশরাফ।