ইসলাম

সৃষ্টি ছেড়ে স্রষ্টার টানে

ড. মো. আব্দুল্লাহেল বাকী

হজের সর্বপ্রথম আনুষ্ঠানিকতা হলো ইহরাম। ইহরাম পোশাকের ব্যাপারে হাজিকে তার দীর্ঘদিনের অভ্যাস পরিবর্তনে বাধ্য করে। পোশাক-পরিচ্ছদের আকর্ষণ ধ্বংস করে, রঙ, ডিজাইন, আকার-আকৃতির বিষয়ে তার নিজস্ব পছন্দ-অপছন্দের প্রক্রিয়া বিনষ্ট করে। ইহরামের নিয়ত করার পর হাজি যে তালবিয়া পাঠ করেন, তা ভাষাকেন্দ্রিক আকর্ষণ নিশ্চিহ্ন করে। হাজি সুস্পষ্টভাবে বলে দেন যে পোশাকসহ যাবতীয় বস্তুর প্রতি আকর্ষণের যত উপাত্ত, তা আমি অগ্রাহ্য করছি। আমার কাছে এখন কোনো কিছুর রঙ, ডিজাইন ও আকার-আকৃতির মূল্য নেই। আমি এসবের গুণাবলি সৌন্দর্য বা ক্ষমতায় বিশ্বাস করি না। হাজি এখন রঙ, ডিজাইন ও আকার-আকৃতির ঊর্ধ্বে তার স্রষ্টা আল্লাহর প্রশংসা তার শুকরিয়া ও তার শক্তি ক্ষমতাই মুখ্য বলে বিবেচনা করে। এভাবে ইহরাম হাজিকে হজের সূচনাতেই বস্তুর প্রতি আকর্ষণের ভিত্তি উপড়ে ফেলে। এখন হাজি অতি সহজেই তার প্রিয় ঘরবাড়ি, দেশ, মহাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্রষ্টার সন্তুষ্টির পথে কাবার দিকে অগ্রসর হয়।

হাজি প্রবেশ করে মক্কা-মদিনার হোটেলে। হোটেলের ছোট্ট রুমে চার-পাঁচজন গাদাগাদি করে থাকে। একটা খুবই অপরিসর টয়লেট সবাই মিলে শেয়ার করে। হোটেল/টয়লেট/রুমের বস্তুগত সংকোচন হাজিকে আল্লাহপ্রাপ্তির অনুভূতি থেকে মোটেও টলাতে পারে না।

হজের মূল আনুষ্ঠানিকতার শুরুতে দামি বড় সুটকেস হোটেলে রেখে ছোট এক ব্যাগ হাতে হাজি মক্কার হোটেল ছেড়ে যায় মিনার তাঁবুতে। তার বস্তুগত সুযোগ-সুবিধা মারাত্মকভাবে কমে যায়। এখানে খাট নেই, রুমের সঙ্গে সংযুক্ত বাথরুম নেই। ৫০-৬০ জনের জন্য এক বাথরুম। হাজি হাল ছাড়েন না। সব ধরনের বস্তুগত কমতি মেনে নিয়ে হাজি অপেক্ষায় থাকেন মালিকের সন্তুষ্টির আশায়।

৯ জিলহজ হাজি যান আরাফাতে। মিনার চেয়েও সংকুচিত বস্তুগত আয়োজন। মিনার ব্যাগের চেয়েও ছোট এক পলিথিনে একটি পানির বোতল, জরুরি ওষুধ, একটি ছাতা, এক জোড়া ইহরামের কাপড়— এই হলো হাজির সম্বল। সাধারণ কোনো এক ভিক্ষুকের চেয়েও অধম। মিনার চেয়েও সাধারণ তাঁবু, তোশক-বালিশবিহীন ধুলাবালি ভরা সামান্য এক কার্পেট। এত বড় বস্তুগত অপ্রাপ্তির পরও হাজির কোনো আফসোস নেই, কোনো অসন্তুষ্টি নেই। পরিপূর্ণ বিশ্বাস আর আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে হাজি চেয়ে থাকেন সুদূর-আকাশের অন্য প্রান্তে মালিকের আরশ থেকে ক্ষমাপ্রাপ্তির ঘোষণার অপেক্ষায়। অতীতের বস্তুপ্রেমের অভিশাপে জমে থাকা পাপের পাহাড় বস্তুশূন্য আরাফায় প্রাপ্ত ক্ষমার ঢলে বিলীন হয়ে যায়। হাজি মুগ্ধ, হাজি তৃপ্ত হয়। হজ আনুষ্ঠানিকতার প্রায় শেষ অংশে হাজি আসে মুজদালিফায়। তাঁবু নেই, কার্পেট নেই। থাকার জন্য কোনো নির্দিষ্ট জায়গা নেই। খাওয়া-দাওয়ার জন্য কোনো দায়িত্বশীল নেই। গায়ে শক্তি নেই, মাথায় বুদ্ধি নেই। বস্তুগতভাবে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত মাথার ওপরে সুবিস্তীর্ণ আকাশ আর নিচে বালু পাথরের নুড়ির বিছানায় ক্লান্ত-শ্রান্ত হাজি উপভোগ করে জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ ঘুম। আর অর্জন করে পরিপূর্ণ ক্ষমা ও নাজাত।

বস্তু থেকে বিচ্ছিন্নতার প্রাপ্তি নিয়ে তৃপ্ত হাজি অগ্রসর হয় সম্মাননা গ্রহণ করতে কাবার পথে। হাজি যেন কোনোভাবেই এ সাফল্য ধরে রাখতে না পারে, সে জন্য মাঝপথে বাদ সাধে শয়তান। হাজিও সর্বশক্তি দিয়ে শয়তানকে প্রত্যাখ্যান করে মিনায় পাথর নিক্ষেপের মাধ্যমে। এরপর শয়তানমুক্ত জীবনের প্রথম স্বাদ উপভোগ করে পশু কোরবানির মাধ্যমে। বাকি জীবন এভাবেই বস্তুর অবৈধ আকর্ষণ থেকে মুক্ত থেকে স্রষ্টার ভালোবাসার ছায়াতলে শান্তি খোঁজার প্রত্যয় ব্যক্ত করে।

হাজি কাবায় এসে সুমহান প্রতিপালকের সর্বোচ্চ সান্নিধ্য লাভ করেন। আল্লাহর আকর্ষণে ঘুরতে থাকেন। বস্তুর ওপর নির্ভরশীলতা থেকে মুক্তি পান। বস্তুগত বিষয়ের ভালোবাসা, ভয় ও আকর্ষণ থেকে মুক্ত হয়ে আল্লাহর ভয় ও ভালোবাসায় নিমগ্ন হন। কাবার তওয়াফ হাজিকে কাবাকেন্দ্রিক আল্লাহপ্রেমের বলয়ে প্রবেশ করান। ঘড়ির কাঁটার দিকে চলা হাজি এখন ঘুরে ঘড়ির কাঁটার উল্টোদিকে।

হজের কার্যক্রম পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে দেয়, আল্লাহ বস্তুগত দ্রব্যাদির ওপর নির্ভরশীলতা ছাড়াও মানুষকে বাঁচাতে পারেন। এসব বস্তুর নিজস্ব কোনো ক্ষমতা বা গুণাগুণ নেই। এগুলো মানুষকে দেওয়া হয় পরীক্ষার সামগ্রী হিসেবে। সে এসব কতটুকু যত্ন যোগ্যতা ও সতর্কতাসহ সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারে, তা দেখার জন্য। প্রমাণ করার জন্য যে সে যোগ্য অথবা অযোগ্য। যেহেতু আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সব বস্তুনিচয়ের স্রষ্টা, সেজন্য তার নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যবহার করলে এসবের ফলাফল পাওয়া যায়। যদি নির্দেশনা অমান্য করে অন্য কোনো পদ্ধতিতে এসব ব্যবহার করা হয়, তাহলে অকল্যাণ ও অমঙ্গল হয়।

পার্থিব জীবনের যাবতীয় বস্তুনিচয় সম্পর্কে হাজির এ ধারণা তাকে আর দশজন বস্তুপাগল মানুষ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা করে ফেলে। সে বুদ্ধিমত্তা যোগ্যতা, দক্ষতা এবং বৈধ-অবৈধতার ভিত্তিতে বস্তুর ভোগ-দখল করার চেষ্টা করে। ফলে পৃথিবীতে বস্তু নিয়ে মানুষের দলাদলি হানাহানির অবসান ঘটে।

লেখক : সাবেক অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

আরও সংবাদ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to top button