
৩০ মে আমাদের পরিবারের জন্য সবচেয়ে বেদনাদায়ক দিন। এই দিনে এ দেশের লাখো-কোটি মানুষ যেমন তাদের প্রাণপ্রিয় নেতা রাখাল রাজা জিয়াউর রহমানকে হারিয়েছিলেন, তেমনি আমরা দুই ভাই হয়েছিলাম এতিম। পৃথিবীতে বাবা বলে সম্বোধন করার আর কেউ রইল না। গভীর রাতে ঘুমন্ত অবস্থায় আর কারো মায়াবী হাতের স্পর্শ পাবো না। আমরা দুষ্টুমি করলে কানমলাও খাবো না। ২১ বছর আগের এইদিনের কথা দীর্ঘ সময় ধরে যতবারই মনে হয়েছে, ততবারই শোকে মূহ্যমান হয়েছি, বেদনায় ভারাক্রান্ত হয়েছে আমার হৃদয়। ক্ষণিকের জন্য হলেও হারিয়ে যাই অন্য পৃথিবীতে যেখানে শুধু আমি আর আমার বাবা। আজ আমিও এক সন্তানের জনক। কিন্তু ক্যালেন্ডারের পাতায় ৩০ মে ঘুরে এলেই ফিরে যাই অনেক আগের সেইদিনে। নিজেকে এতিম অসহায় সেই কিশোরই মনে হয়। জীবনের স্বাপদ-সঙ্কুুল যাত্রাপথকে পাড়ি দিতে গিয়ে জীবনের বহু স্মৃতি আবছা হয়ে গেছে বা যাচ্ছে। কিন্তু একমাত্র এইদিনের স্মৃতি মনের মণিকোঠায় গেঁথে আছে স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ ও স্পষ্ট। আমার বিশ্বাস, আমি আমার প্রাণপ্রিয় ছোট ভাই কোকো এবং আরো যারা আছেন আমাদের মতো পিতৃহারা, একমাত্র তারাই এই ব্যথা অনুভব করতে পারবেন।
১৯৮১ সালের পর ৩০ মে বহুবার এসেছে জীবনে। যতদিন বেঁচে থাকব ঘুরে ঘুরে প্রতি বছর দিনটি আসবে। কিন্তু আমরা তো কখনো ১৯৮১ সালের ২৯ মে’তে ফিরে যেতে পারব না। ৩০ মে’র পর যখন দেখলাম লাখ লাখ মানুষ চোখের পানি দিয়ে অভিসিক্ত করেছে তাদের প্রাণপ্রিয় নেতার কফিনকে, শোকে মূহ্যমান হয়ে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে প্রাণপ্রিয় নেতার কফিনের পেছনে দাঁড়িয়েছেন তাকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে, তখন শুধু এটুকুই মনে হয়েছিল, একটি মানুষ কিভাবে এত লাখো-কোটি মানুষকে আপন করে নিতে পারেন, কেমন করে পারেন কোটি মানুষের হৃদয়ে ঠাঁই করে নিতে? কেন বৃদ্ধ জরিনা বেগম তার মৃত্যু সংবাদ শুনার সাথে সাথে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল? কেন ৮০ বছরের বৃদ্ধ আ. রশিদ ৫০ মাইল পথ পাড়ি দিয়ে অজোপাড়া থেকে ঢাকায় এসেছিল তার লাশ একনজর দেখার জন্য? তার জানাজায় সমগ্র বাংলাদেশ কেন একটি কফিনের পাশে দাঁড়িয়েছিল? বুক চাপড়িয়ে হাজার হাজার মানুষ কেন মাতম করেছিল? একজন মানুষের জনপ্রিয়তা কতটা তুঙ্গে উঠতে পারলে এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে, তা সাধারণ জ্ঞানসম্পন্ন মানুষমাত্রই অনুধাবন করতে পারেন। সেই লাখো-কোটি মানুষের প্রাণপ্রিয় মানুষের সন্তান আমি। এটি মনে হলে গর্বে আমার বুক ভরে যায়। বাবাকে হারানোর ব্যথা একটু হলেও লাঘব হয়। যখন মনে পড়ে, লাখ লাখ লোক জানাজায় এবং রেডিও ও টিভির সামনে বসে কোটি কোটি মানুষ রাব্বুল আল-আমিনের দরবারে তাদের প্রিয় মানুষটির জন্য দোয়া করছে, তখন পিতার মৃত্যুর বেদনা অল্প হলেও প্রশমিত হয়। আজো মনে পড়ে জানাজার দিনের সেই অচেনা মুরুব্বির কথা। আমি যখন কাঁদছিলাম, তিনি আমাকে শান্তনা দিয়ে বলেছিলেন, ‘বাবা কাঁদতে নেই, দেখ লাখ লাখ মানুষ এসেছে তোমার বাবার জানাজায়। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমার বাবাকে বেহশত নসিব করবেন। তোমরা কাঁদলে তোমার বাবার আত্মা কষ্ট পাবে।’ আজো যখন বাদ জুমা বাবার কবর জিয়ারতে যাই, একজন মানুষ হলেও পাই সেখানে সেই সময়ে, যে তার নেতার জন্য, তার প্রিয় মানুষটির জন্য দু’হাত তুলে দোয়া করছে। যাকে আগে কোনো দিন দেখিনি, হয়তো আর কোনো দিন দেখবও না। এত এত মানুষের দোয়ার জন্যই হয়তো আজো মাঝে মধ্যে মনে হয়, বাবা আমাদের মধ্যেই আছেন। হয়তো অফিসে গেছেন অথবা গ্রাম-বাংলার অজোপাড়াগাঁয়ের মেঠোপথে হাঁটছেন, গ্রামের মানুষদের অবস্থা স্বচক্ষে দেখছেন, তাদেরকে বিভিন্ন পরামর্শ দিচ্ছেন, কাজ শেষ হলেই চলে আসবেন। যেমন মনে হয়েছিল ২৯ মে ১৯৮১ সালে।
আমার বাবা যখন মারা যান, তখন আমার বয়স ১৪/১৫ এবং কোকোর বয়স ১২/১৩ বছর, অর্থাৎ যে সময় একজন কিশোরের জীবনের পথ চলতে, নিজের জীবনকে গড়তে শেখার জন্য দরকার তার জীবনের নির্ভরযোগ্য শিক্ষককে, অর্থাৎ তার বাবাকে। কিন্তু আমার এবং কোকোর এই শিক্ষকের কাছ থেকে সরাসরি খুব বেশি কিছু শেখার অবকাশ হয়নি। সুযোগ হয়নি। তার প্রধান কারণ, আমাদের এই শিক্ষকের কাঁধে ন্যস্ত ছিল, সেই সময়ে সমগ্র দেশ ও জনগণের গুরু দায়িত্ব। একটা বিস্রন্ত, বিপর্যস্ত, ক্লিষ্ট, মূহ্যমান, আশাহীন, ভাষাহীন, স্বপ্নহীন হাড্ডি কঙ্কালসার দেশকে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য দিনে ১৮ ঘণ্টা পরিশ্রম করেছেন। তিনি যখন বাসা থেকে বের হতেন তখন আমরা হয়তো ঘুমিয়ে থাকতাম নয়তো স্কুলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হতাম। তিনি যখন বাসায় ফিরতেন তখন আমরা ঘুমিয়ে থাকতাম। মাঝে মধ্যে ঘুমের মধ্যেই তার হাতের স্পর্শ পেতাম। চোখে-মুখে-কপালে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। তাই জীবনের পরবর্তী সময়ে আমাদের শিখতে হয়েছে এই শিক্ষকের রেখে যাওয়া সততা থেকে। শিখতে হয়েছে তার রেখে যাওয়া আদর্শ থেকে, দেশপ্রেম থেকে। সেইসব কর্ম থেকে, যা তিনি একজন পিতা হিসেবে আমাদের দিয়ে করিয়েছিলেন, করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন তা থেকে। তারই ছোট কয়েকটি ঘটনা আজ লিখব। ঘটনাগুলো বিচার করলে এর প্রভাব আমাদের জীবনে অনেক।
ক. ১৯৭৬ সালের কথা। তখন স্কুলে পড়ি। প্রতিদিনের মতো সেদিনও দু’ভাই স্কুলে যাচ্ছি। সকাল ৭টায় সেদিন আমরা বের হচ্ছি। বাবা অফিসে যাচ্ছেন। গাড়িতে গিয়ে উঠলাম। বাবা তার গাড়িতে উঠলেন। তার গাড়ি বেরিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ তার গাড়ির বেকলাইট জ্বলে উঠল। বাসার গেট থেকে বেরুবার আগেই জোর গলায় আমাদের ড্রাইভারকে ডাক দিলেন। সে দৌড়ে গেলো। আমরা গাড়িতে বসা। ড্রাইভার যখন ফিরে এলো চেহারা দেখে মনে হলো বাঘের খাঁচা থেকে ফিরেছে। জিজ্ঞেস করলাম, কি ব্যাপার? উত্তরে বলল, ‘স্যার বলেছেন, আপনাদের এই বেলা নামিয়ে দিয়ে অফিসে গিয়ে পিএসের কাছে রিপোর্ট করতে। এখন থেকে ছোট গাড়ি নিয়ে স্কুলে যাতায়াত করতে হবে। কারণ ছোট গাড়িতে তেল কম খরচ হয়। আর এই গাড়ির চাকা খুলে রেখে দিতে হবে।’ উল্লেখ্য, এ গাড়িটি ছিল সরকারি দামি বড় গাড়ি।
খ. তখন আমার বয়স কম। স্কুলে পড়ি। কিছু গালাগাল রপ্ত করেছি। সময় পেলেই আক্রমণের সুযোগ হাতছাড়া করি না। সেদিনও করিনি। কারণটি পুরোপুরি মনে নেই। তবে বাসার বাইরে গেটের সামনে সন্ধ্যাবেলা পাড়ার বন্ধুদের সঙ্গে দুষ্টুমি করছি। রাস্তা দিয়ে মাঝে মধ্যেই গাড়ি আসা-যাওয়া করছে। গেটে কর্তব্যরত সেনাবাহিনীর গার্ড, দাঁড়িয়ে ডিউটিতে। আমাকে বলল, ‘ভাইয়া, সন্ধ্যা হয়ে গেছে। ভেতরে যান।’ আর যায় কোথায়? খেলার মধ্যে বিড়ম্বনা। যা এলো মুখে স্বরচিত কবিতার মতো বলে গেলাম। খেলা শেষ। ভেতরে এলাম। ক্লান্ত। কোনো মতে পড়া শেষ করে রাতে খেয়ে ঘুম। ঘুমিয়েছি বোধ হয় ঘণ্টা দেড়েক। হঠাৎ মনে হলো ভূমিকম্প হচ্ছে। চোখ খুলে দেখি, শিকারের সময় বাঘ থাবা দিয়ে যেভাবে হরিণ শাবক ধরে, বাবা ঠিক সেভাবে হাত দিয়ে আমার মাথার চুল ধরে টেনে তুললেন এবং বাঘের মতো গর্জন করে বললেন, ‘কেন গাল দিয়েছিস? ও কি তোর বাপের চাকরি করে। যা মাফ চেয়ে আয়।’ আম্মাকে বললেন, ‘যাও ওকে নিয়ে যাও। ও মাফ চাবে তারপর ঘরে ঢুকবে।’ মা আমাকে নিয়ে গেলেন সামনের বারান্দায়। বিনা দোষে গাল খাওয়া ব্যক্তিটিকে ডেকে আনা হলো। যদিও লোকটি অত্যন্ত ভদ্রতার সাথে আম্মাকে বলল, ‘না ম্যাডাম, ভাইয়ার কথায় আমি কিছুই মনে করিনি। ছোট মানুষ। ওমন করেই।’ ‘জানি না, তিনি আজ কোথায়? তবে ২৬ বছর পরে আজ যদি বেঁচে থাকেন এবং এই লেখা পড়েন, তবে বলছি, ‘সেদিন আমি না বুঝে যা বলেছি, তার জন্য আজ আমি আপনার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী।’
গ. তখন বাবা প্রেসিডেন্ট। হঠাৎ বিটিভি থেকে খবর এলো, যেতে হবে। গেলাম। তারা বললেন, গান গাইতে হবে। বয়স কম। গানের ‘গ’ ও পারি না। তাও আবার টিভিতে। আমাকে পায় কে। প্রযোজক বললেন, কিছু না। আমি ঠিকই গান গাইয়ে নেবো প্রেসিডেন্টের ছেলেকে দিয়ে এবং সুন্দর গান হবে। বুঝতেই পারছেন সবাই, কি গান গাইলাম। পরে যখন নিজে দেখলাম ও শুনলাম, মনে হলো সেই মুহূর্তে টিভি স্টেশনে কারেন্ট চলে গেলে ভালো হতো। যদিও রাতে স্বপ্ন দেখলাম, বিরাট গায়ক হয়ে গেছি। ক’দিন পর প্রযোজককে ফোন করলাম, ‘চাচা, আবার কবে গান গাইব।’ উনি বললেন, ‘বাবা প্রেসিডেন্টের পিএস ফোন করে তোমাকে টিভিতে অনুষ্ঠান দিতে বারণ করেছেন।’ ব্যস গায়ক হবার খায়েস মিটে গেল।
ঘ. সম্ভবত ১৯৭৯ সালের নভেম্বর মাসে উত্তর কোরীয় শিশুশিল্পীরা শিল্পকলা একাডেমিতে তিন দিনব্যাপী নৃত্য, সঙ্গীত ও সার্কাস দেখাচ্ছিল। আমার অনেক বন্ধুই সে অনুষ্ঠান দেখার জন্য যাবে বলে মনস্থির করেছিল। আমরা দু’ভাইও অনুষ্ঠান দেখার জন্য আম্মাকে বলি। আম্মা বঙ্গভবনে ফোন করলে বঙ্গভবন থেকে শিল্পকলা একাডেমিতে ফোন করে দেয়া হয় আমাদের বসার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করতে। এরই মধ্যে বাবার কানে গেল কথাটা। উনি বললেন, যদি ওদেরকে অনুষ্ঠান দেখতেই হয় তবে প্রেসিডেন্টের পরিচয় না দিয়ে সাধারণ লোকেরা যেভাবে বসে অনুষ্ঠান দেখে তাদেরকে সেভাবে দেখতে হবে। যথা আদেশ তথা কাজ। একটি সাধারণ গাড়িতে করে বঙ্গভবনের একজন কর্মকর্তা আমাদেরকে শিল্পকলা একাডেমিতে নিয়ে গেলেন এবং একদম পেছনের সারিতে বসিয়ে দিলেন। আমরা খুব কষ্ট করে অনুষ্ঠান উপভোগ করলাম।
ঙ. বাবার প্যান্ট-শার্ট ছোট হয়ে গেলে বঙ্গভবনের দর্জিকে দিয়ে ওগুলো ছোট করে আমাদের জন্য তৈরি করা হতো। আমরা বাসায় সচরাচর ওসব প্যান্ট-শার্ট পরতাম। বাইরে যাবার জন্য দুটো ভালো জামা-কাপড় ছিল। বন্ধুদের দেখতাম কত দামি দামি কাপড় পরে। এই সমস্ত পুরোনো প্যান্ট-শার্ট নিয়ে অনুযোগ করলে বলতেন, ‘তোমাদের বাবা বড়লোক নন। সামান্য ক’টাকা বেতনের চাকরি করেন। সুতরাং তোমাদের তাই পরতে হবে।’ পরে অবশ্য এব পুরোনো কাপড় বাসায় পরা আমাদের অভ্যাস হয়ে যায়। তাই আর অনুযোগ করিনি।
চ. ১৯৮০ সালের ঘটনা। আব্বা শহীদ হওয়ার বছর খানেক আগের কথা। একদিন সন্ধ্যা বেলা দু’ভাই পরামর্শ করে বড় ভাই হিসেবে আমি গিয়ে দাঁড়ালাম আম্মার সামনে। বললাম, ‘আম্মু আমরাও যাব তোমাদের সাথে।’ উনি বললেন, ‘কোথায়’। আমি বললাম, ‘কেন, নেপাল।’ কারণ এর কয়েক দিন আগে নেপালের রাজা বীরেন্দ্র বীর বিক্রম শাহদেব, রানী ঐশর্য্যলক্ষ্মী ও তাদের দু’ছেলে বাংলাদেশ সফরে আসেন।
ফিরতি সফরে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে আব্বা-আম্মাকে নিয়ে দু’দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে নেপাল যাচ্ছিলেন। তাই আমরাও ভাবলাম রাজার ছেলেরা যদি আসতে পারে, তবে আমরাও যেতে পারি। সমস্যা কোথায়? আম্মা আমার উত্তর শুনে মুচকি হাসলেন। এদিকে আব্বা কোন সময়ে পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন খেয়াল করিনি। হঠাৎ পেছনে থেকে ভারী গলার আওয়াজ এলো। কিন্তু তাতে ছিল স্নেহের পরশ। ‘তা ঠিক, রাজার ছেলেরা এসেছিল বাংলাদেশে। কারণ তারা রাজার ছেলে। কিন্তু তোমরা যে যেতে চাচ্ছ, তোমরা তো রাজার ছেলে নও। তোমরা যেতে পারবে না। কারণ আমি যাচ্ছি রাষ্ট্রীয় সফরে। তোমরা যদি সাথে যাও, মানুষ আমাকে মন্দ বলবে। তুমি কি তাই চাও?’
প্রথমে খুব ভয়ে কথাগুলো শুনলাম। পরে বুঝলাম আব্বা কি বোঝাতে চাচ্ছেন। যদিও দুই ভাই একটু মন খারাপ করলাম। তবে তা ছিল সাময়িক।
ছ. আব্বু খুব সকালে ঘুম থেকে উঠতেন। প্রায়ই তাহাজ্জুতের নামাজ পড়তেন। তারপর বাসার আঙ্গিনায় অর্থাৎ খোলা জায়গায় জগিং করতেন। ফজরের নামাজের আজান শোনার পর তিনি নামাজ পড়ার জন্য প্রস্তুতি নিতেন। মাঝে মধ্যে ব্যায়াম শেষ করে বাসার বাইরে ব্যারাকে অবস্থানরত সৈনিকদের ঘুম থেকে জাগাতেন এবং তাদেরকে নিয়ে এক সঙ্গে নামাজ পড়তেন। অনেক সময় হাবিলদার মুজিব ও হাবিলদার লুৎফর বেশি রাত ডিউটি করার ফলে ঘুম থেকে উঠতে দেরি করত। তখন আব্বা তাদের দরজায় হাত দিয়ে ঠুক ঠুক আওয়াজ করতেন এবং নাম ধরে ডাকতেন। কখনো কখনো তাদের ঘুম ভাঙতে ৫/১০ মিনিট লাগত। তিনি কিছুই মনে করতেন না; বরং তাদের ঘুম ভাঙানোর জন্য অনুতপ্ত হতেন এবং পরক্ষণেই বলতেন, আমি এভাবে ঘুম না ভাঙালে তোমরা ফজরের নামাজ আদায় করবে না। তাই বাধ্য হয়েই তোমাদেরকে জাগাতে হয়। প্রত্যেক মুসলমানেরই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা কর্তব্য। তোমরা আমার বাসায় ডিউটিরত। সুতরাং তোমরা আমার পরিববারের সদস্য এবং ছোট ভাইয়ের মতো। অভিভাবক হিসেবে, বড় ভাই হিসেবে তোমরা যাতে নামাজ পড় সেটি দেখাশোনা করা আমার দায়িত্ব। নয়তো তার জন্য মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে আমাকে জবাবদিহি করতে হবে। আমরা হয়তো ছোট ছিলাম বিধায় তখন আব্বুর হাত থেকে রক্ষা পেয়েছি।
জ. আব্বু যখন প্রেসিডেন্ট হলেন, তারপর থেকে আমরা অনেকটা আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে দূরে ছিলাম। কোনো আত্মীয়-স্বজন সহজে আমাদের বাসায় আসত না। আমরাও যেতাম না। আম্মুকে এর কারণ জিজ্ঞেস করলেন উনি বললেন, তোমার আব্বা এখন দেশের প্রেসিডেন্ট। তিনি চান না কোনো আত্মীয়-স্বজন তার বাসায় আসুক। এতে তার বদনাম হবে। যেহেতু তোমার আব্বু চান না কেউ এখানে আসুক বা তোমরা আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে যাও, সুতরাং তোমাদেরকে কষ্ট করে হলেও এই আদেশ মেনে চলতে হবে। কী আর করা! ঐ যথা আদেশ তথাস্তু।
সব স্মরণীয় ঘটনা এই স্বল্প পরিসরে লেখা সম্ভব নয়। উল্লিখিত ঘটনাগুলো বহু ঘটনার মধ্যে সামান্য কয়েকটি মাত্র, পড়লে মনে হবে আর সব ঘটনার মতো স্বাভাবিক। কিন্তু এইসব ঘটনা থেকে আমরা দু’ভাই যা শিখেছি, তার কিছু ব্যাখ্যার হয়তো প্রয়োজন আছে। আজ যারা বয়সে আমার চেয়ে ছোট তাদের জন্য, এমন কি ক্ষেত্র বিশেষে অনেক বয়স্কেরও শেখার আছে। যেমন গাড়ির যে ঘটনাটি লিখেছি, তা থেকে যা শিখেছি, তা হলো জীবনে যতটুকু সম্ভব অপচয় না করা এবং একই সাথে অহেতুক বিলাসিতা না করা। শুধু তাই নয়, নিজের যোগ্যতা অর্জন করে তারপরই কোনো কিছু ভোগ করা উচিত। একইভাবে দ্বিতীয় ঘটনা থেকে একজন মানুষের এটিই শিক্ষা নেয়া উচিত, কোনো সামাজিক অবস্থান থেকেই আরেকজন মানুষকে কোনো কটু কথা বলা অথবা যা জীবনের একটি মূল্যবান শিক্ষা। মানুষের জীবনে চলার পথে বহু ঘটনা এবং কমবেশি প্রতি ঘটনা থেকেই মানুষ শিক্ষা নিতে পারে। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো একটি দরিদ্র দেশে, যেখানে আমাদের মতো লোক যারা কিছুটা হলেও ভালো থাকি, সামাজিক সুযোগ-সুবিধা ভোগ করি, তাদের উচিত সুযোগ বা সুবিধা থাকলেই তা ব্যবহার করতে হবে এই মানসিকতা ত্যাগ করা। তাতে হারানোর কিছু নেই; বরং পাওয়া যায় মানুষের শ্রদ্ধা, ভালোবাসা। তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ আমাদের দুই ভাইয়ের বাবা, কোটি কোটি মানুষের নয়নমনি, আধুনিক বাংলাদেশের রূপকার, তৃতীয় বিশ্ব ও ইসলামী বিশ্বের মহান নেতা শহীদ জিয়াউর রহমান।