রাজনীতি ও আমলাতন্ত্রে সংস্কার ছাড়া দুর্নীতি দমন অসম্ভব
বিশেষ সাক্ষাৎকার: ইফতেখারুজ্জামান
প্রথম আলো:
শুরুতেই জানতে চাইব দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশনের কাজ কীভাবে এগোচ্ছে বা কীভাবে চলছে?
ইফতেখারুজ্জামান: টিআইবির কর্মী হিসেবে দুর্নীতি দমন বিষয়ে সমস্যাগুলো মোটামুটি জানা। প্রথমে কাজের পদ্ধতি নির্ধারণ করে আমরা বিভিন্ন অংশীজন, বিশেষ করে দুদকের বর্তমান-সাবেক কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। সমস্যা ও চ্যালেঞ্জগুলো বোঝার চেষ্টা করেছি। দুর্নীতি দমন কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত প্রসিকিউটর, আইনজীবী, বিচারক ছাড়াও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি, ছাত্রসমাজের প্রতিনিধি, শিক্ষক, পেশাজীবীদের কাছ থেকে পরামর্শ নিচ্ছি। ই-মেইলের মাধ্যমে সব ধরনের মানুষের কাছ থেকেও আমরা পরামর্শ চেয়েছি। এতে আমরা খুবই ভালো সাড়া পেয়েছি। ঢাকার বাইরে আমরা পরামর্শ সভা শুরু করেছি। আমরা আশা করছি, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আমরা আমাদের কাজ শেষ করে সরকারের কাছে প্রতিবেদন জমা দিতে পারব।
প্রথম আলো:
সংস্কারের ক্ষেত্রে কোন বিষয়গুলোকে আপনারা গুরুত্ব দিচ্ছেন?
ইফতেখারুজ্জামান: দুদক প্রতিষ্ঠার পেছনে টিআইবির একটি উদ্যোগ ছিল। ফলে দুদকের কার্যক্রমের প্রতি সব সময় আমাদের গভীর পর্যবেক্ষণ ছিল। আমরা দেখেছি, দুদকের চেয়ারম্যান ও কমিশনার নিয়োগের ক্ষেত্রে সব সময় দলীয় ও রাজনৈতিক প্রভাব কাজ করেছে। দুদকে সচিব, মহাপরিচালক বা যে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আছেন, তাঁরা আসেন প্রশাসনিক ক্যাডার থেকে। রাজনৈতিক ও আমলাতন্ত্রের প্রভাবের কারণে দুদককে জিম্মি থাকতে হয়। এর পরের পর্যায়ের যে জনবল আছে, তাদের মধ্যেও বিভাজন ও বৈষম্য আছে। দুদকে অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি, অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলা আছে। সেগুলো থেকে দুদককে কীভাবে মুক্ত করা যায়, তা নিয়ে আমরা ভাবছি।
এ ছাড়া দুদকের নিজস্ব যে আইন আছে, সেখানে কোথায় দুর্বলতা আছে, তা আমরা দেখছি। উচ্চপর্যায়ের দুর্নীতি, বিশেষ করে অর্থ পাচারের ক্ষেত্রে দুদক একা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে না। আইনগত ও বৈশ্বিক চর্চা অনুযায়ী আরও কিছু প্রতিষ্ঠানের (বিএফআইইউ, এনবিআর, সিআইডি, অ্যাটর্নি জেনারেল অফিস) সহযোগিতা ও সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজগুলো করার কথা। সেটি হয়নি; বরং অসুস্থ প্রতিযোগিতা কাজ করেছে। এ বিষয়গুলোও আমরা দেখছি। অংশীজনদের পরামর্শ নেওয়া ছাড়াও আমরা দেখছি আন্তর্জাতিক চর্চা কেমন, নিজেদের অভিজ্ঞতার আলোকে ও পরিপ্রেক্ষিতে তা কীভাবে প্রয়োগ করা যায়।
প্রথম আলো:
দুদক গঠনে সার্চ কমিটি গঠন করা হয়েছে। অনেকে সংস্কার কমিশনের কার্যক্রম চলাকালে এ কমিটি গঠন নিয়েও সমালোচনা করেছেন, বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?
ইফতেখারুজ্জামান: এটি আমাদের জন্য একটি উদ্বেগের বিষয়। সার্চ কমিটির মূল দায়িত্ব কমিশন গঠন। যেটি আবার আমাদের কাজের অন্যতম ক্ষেত্র। সেটির ওপরই অনেক কিছু নির্ভর করবে। এখন এটি হয়ে গেছে অনেকটা উভয়সংকটের মতো। যে পরিপ্রেক্ষিতেই হোক, দুদকের চেয়ারম্যান ও কমিশনার পদত্যাগ করেছেন। এখন দুদক এমন একটি প্রতিষ্ঠান, সেখানে এসব সদস্য না থাকলে কোনো সিদ্ধান্ত হয় না। ফলে যত দ্রুত সম্ভব কমিশন গঠন করা বাঞ্ছনীয়, আইনগতভাবেও বাধ্যবাধকতা আছে। কারণ, কী প্রক্রিয়ায় ব্যক্তিদের বাছাই করা হয়, কাদের নিয়োগ দেওয়া হয়, তাঁদের মৌলিক যোগ্যতা কী হবে—এসব বিষয় পুনর্বিবেচনা করতে হচ্ছে। এখন তিন সদস্যের কমিশন, সেই সংখ্যা বাড়বে কি না, তাঁরা কোন পেশার হবেন, মেয়াদ কত দিন হবে—এসব বিষয় তো আমাদের বিবেচনা করতে হচ্ছে। আমাদের সুপারিশমালা প্রণয়ন, সেটির ওপর ভিত্তি করে সার্বিক সংস্কার—এসব সাপেক্ষে যদি নতুন কমিশন গঠন করা যেত, তাহলে সেটি ইতিবাচক এবং আরও বেশি সহায়ক হতো।
প্রথম আলো:
বিগত সরকার দেশকে দুর্নীতির মহাসমুদ্রে নিমজ্জিত করেছিল। সেখান থেকে উত্তরণের পথ আসলে কী? নাকি সেই ‘সংস্কৃতি’ আমাদের বহন করেই যেতে হবে?
ইফতেখারুজ্জামান: যেকোনো প্রকারে ক্ষমতায় থাকতে বিগত কর্তৃত্ববাদী শাসনের সময় প্রতিষ্ঠানগুলোকে খর্ব ও অকার্যকর করা হয়েছে। তারা ক্ষমতার অপব্যবহার করে রাষ্ট্রীয় সম্পদ হরণ থেকে শুরু করে বিদেশে অর্থ পাচারের সুযোগ সৃষ্টি করতে অবারিত জবাবদিহিহীনতা ও বিচারহীনতার ক্ষেত্র তৈরি করেছিল। তারা মনে করেছিল, একটা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত পেয়ে যাবে। সে কারণেই কিন্তু জনগণের অসন্তোষ ও গণবিস্ফোরণ আমরা দেখলাম।
পৃথিবীর সব দেশেই কিন্তু কমবেশি দুর্নীতি হয় এবং আইনের চর্চার মধ্য দিয়ে তা নিয়ন্ত্রণও করা হয়। অনেক দেশ আছে, যেখানে কোনো কমিশন বা দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানই নেই। এরপরও সেসব দেশে দুর্নীতি দমন করা সম্ভব হয়। কারণ, রাষ্ট্রকাঠামোতে আইনের শাসনের চর্চা আছে। আমলাতন্ত্রও দুর্নীতি প্রতিরোধক পরিবেশ সৃষ্টিতে ভূমিকা পালন করে থাকে। সেই জায়গাতেই মূলত আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জ। আমরা যদি এ সংস্কার কার্যক্রমের মাধ্যমে একটি আদর্শ ও বিশ্বমানের দুদক পেয়েও যাই, তারপরও কিন্তু এ কমিশন কার্যকরভাবে তার ভূমিকা পালন করতে পারবে না, যত দিন পর্যন্ত না এ দেশের রাজনীতি ও আমলাতন্ত্রের মধ্যে সাংস্কৃতিক ইতিবাচক পরিবর্তন হবে। দুঃখজনক হচ্ছে, সরকার পতনের দিন বিকেল থেকেই কিন্তু দখলবাজি, চাঁদাবাজি ও দলবাজি এবং এরপর নিয়োগবাজি শুরু হয়ে গেছে। তার মানে, আমরা আগের সংস্কৃতিরই পুনরাবৃত্তি দেখতে পাচ্ছি। এখন কর্তৃত্ববাদী শাসনকে পতনের মধ্য দিয়ে ছাত্র–জনতার যে নৈতিক শক্তির বিকাশ ঘটেছে, সেটিকে দুর্নীতি–প্রতিরোধী শক্তি হিসেবে রূপান্তর করতে হবে। তারা যেমন রাজনীতি, রাষ্ট্র, সরকারকে দুর্নীতির ব্যাপারে জবাবদিহি প্রদর্শন করতে বাধ্য করবে, আবার নিজেরাও দুর্নীতি থেকে দূরে থাকবে।
প্রথম আলো:
টিআইবির প্রতিবেদন বলছে, অর্থ পাচারের তথ্য পাওয়ার পরও দুদক, সিআইডি, এনবিআর, বিএফআইইউ এসবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি। তার মানে কি বলা যায়, রাষ্ট্রীয় বা সরকারি ব্যবস্থায় এ অর্থ পাচারের ঘটনাগুলো ঘটেছে?
ইফতেখারুজ্জামান: দেশ থেকেযে প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অর্থ পাচার হয়, সেসব প্রক্রিয়া থেকেই বোঝা যায়, সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানের প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। বেনামি মালিকানা সৃষ্টি করে ব্যাংক খাতকে কবজা করে সেখান থেকে অর্থ লুটে নেওয়া হয়েছে। সেটি করতে সুযোগ করে দিয়েছে গোয়েন্দা সংস্থা, বাংলাদেশ ব্যাংক, বিএফআইইউর মতো প্রতিষ্ঠানগুলো। সাবেক ভূমিমন্ত্রীর মতো অসংখ্য লুটেরাকে অর্থ পাচারের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। পৃথিবীতে যেসব দেশ থেকে সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার হয়, বাংলাদেশ কিন্তু তাদের মধ্যে অন্যতম একটি দেশে পরিণত হয়েছে। যে পরিমাণ বৈদেশিক সহায়তা আমরা পাই, তার থেকে পাঁচ গুণ এখান থেকে পাচার হয়ে গেছে। ফলে এখানে বিশাল একটা অর্থনৈতিক চাপও সইতে হচ্ছে আমাদের, যেটি অনেক দিন আমাদের টেনে নিয়ে যেতে হবে। দুর্নীতি বা অর্থ পাচার যে আগেও হয়নি তা নয়, তবে বিগত সরকারের সময় এটির ধারাবাহিক সংস্কৃতির ন্যক্কারজনক বিকাশ ঘটেছে। মাত্রাহীন একটি অসুস্থ প্রতিযোগিতা দেখা গেছে। এটি করতে গিয়ে তারা নিজেদের ফ্রাংকেনস্টাইন তৈরি করে ফেলেছিল। আর এর শিকার হয়েছে তারা নিজেরাই।
এখন রাষ্ট্রে দুর্নীতি–প্রতিরোধী সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করতে পারে সেটি হলো, জাতীয় সংসদ। দুর্নীতির অভিযোগের ক্ষেত্রে সংসদীয় কমিটিগুলো পর্যবেক্ষণ ও অনুসন্ধানের মধ্য দিয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করবে এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে তারা জবাবদিহির আওতায় আনবে। এটি আমাদের কোনো সংসদেই কিন্তু হয়নি। শুধু নামমাত্র কমিটিগুলো হয়ে থাকে, তাদের যে মাসিক বৈঠক করার নীতি আছে, সেটিও করতে পারে না অনেক কমিটি। এ কারণে আসলে দুর্নীতির বিষয়গুলো সুরক্ষিতই হয়েছে।
প্রথম আলো:
সরকার বিদেশ থেকে অর্থ ফেরত আনার বিষয়ে তোড়জোড় দেখাচ্ছে। এটি আসলে কতটা সম্ভব?
ইফতেখারুজ্জামান: এটি অবশ্যই সম্ভব, তবে খুবই কঠিন ও জটিল। অর্থ পাচার শুধু আমাদের সমস্যা নয়, এ অর্থ যে দেশে পাচার হচ্ছে, সে দেশেরও সমস্যা। যেমন সাবেক ভূমিমন্ত্রীর যুক্তরাজ্যে কয়েক শ অ্যাপার্টমেন্ট আছে, তা কিন্তু তিনি সে দেশের আইনানুযায়ী করতে পারেন না, মানে সুযোগ থাকার কথা নয়। কিন্তু সেখানেও একটি সংঘবদ্ধ গোষ্ঠী বা সিন্ডিকেট আছে, যারা এ সুযোগগুলো তৈরি করে দেয়। সেই অর্থলগ্নির কারণে তা যুক্তরাজ্যের অর্থনীতিতে যুক্ত হয়ে গেছে। কানাডা, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, দুবাই—সবখানেই একই ঘটনা ঘটেছে। সেই অর্থ ফেরত আনতে গেলে পারস্পরিক আইনি সহযোগিতার মধ্য দিয়ে একটি প্রক্রিয়ায় আমাদের যেতে হবে। এর মাধ্যমে প্রমাণ করতে হবে, পাচার করা অর্থগুলো অবৈধভাবে সেসব দেশে লগ্নি হয়েছে। এটি করতে গিয়ে যে দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হয়, তাতে দেখা যায়, যে দেশ থেকে যে পরিমাণ অর্থ পাচার হয়, সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী তার মাত্র ১ শতাংশ সেই দেশে ফেরত আনা সম্ভব হয়। তবে আমাদের আশাহত হওয়া উচিত হবে না। যেসব দেশে অর্থ পাচার হয়েছে, সেসব দেশ আমাদের জুলাই অভ্যুত্থান এবং বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি যথেষ্ট সহানুভূতিশীল। ফলে স্বাভাবিক সময়ে যে সময় লাগত, তা হয়তো আমাদের লাগবে না, তবে আমাদের তৎপরতা বাড়াতে হবে এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর দক্ষতা, সৎ সাহস ও সম্মিলিত প্রচেষ্টা জারি রাখতে হবে।
প্রথম আলো:
টিআইবি তো ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) একটি চ্যাপটার। যেসব দেশে অর্থ পাচার হয়েছে, সেসব দেশের টিআইয়ের চ্যাপটারগুলো এখানে কতটা ভূমিকা রাখতে পারে?
ইফতেখারুজ্জামান: আমরা এর মধ্যে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নে আমাদের টিআইয়ের যে চ্যাপটার আছে, তারাসহ সেখানকার কয়েকটি নাগরিক সংগঠন মিলে যৌথভাবে সংশ্লিষ্ট সরকারের কাছে এ ব্যাপারে আবেদন জানিয়েছি। সংশ্লিষ্ট দেশগুলো তাদের আইন অনুসারে যথাযথ প্রক্রিয়ায় যত দ্রুত সম্ভব আমাদের সরকারকে যেন সহায়তা করে এবং আমাদের কর্তৃপক্ষগুলোর দক্ষতা উন্নয়নে সহযোগিতা করে এবং পারস্পরিক আইনি চুক্তি করে, যাতে পাচার করা অর্থ ফেরত আনা যায়। ইতিমধ্যে যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টারি গ্রুপ, যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ও ট্রেজারি ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে আমাদের বৈঠক হয়েছে। তারা অত্যন্ত উৎসাহ ও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি দেখিয়েছে। এ ব্যাপারে তাদের অনেকে বাংলাদেশ সফরও করেছেন সহায়তার প্রস্তাব নিয়ে।
প্রথম আলো:
বিগত সরকারের এমপি-মন্ত্রী ও কর্মকর্তাদের নামে যেভাবে মামলা দেওয়া হচ্ছে বা ধরা হচ্ছে, তাতে দুর্নীতির অভিযোগে তাঁদের বিচারের বিষয়টি কতটা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে?
ইফতেখারুজ্জামান: পতিত সরকারের এমপি-মন্ত্রী, ক্ষমতাঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরা, সুবিধাভোগী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে যদি দুর্নীতির মামলাগুলো করা যেত, তাহলে তাঁদের বিচার করা তুলনামূলক সহজ হতো। এখন ঢালাওভাবে তাঁদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দেওয়ার কারণে তাঁদের কতটা জবাবদিহির মুখোমুখি করা যাবে, সে প্রশ্নটা থেকে যাচ্ছে। তবে সুনির্দিষ্ট দুর্নীতির অভিযোগগুলো তদন্তের মাধ্যমে তাঁদের জবাবদিহির আওতায় আনা গেলে একটা দৃষ্টান্ত তৈরি হবে। আগে যেটি করা যায়নি।
প্রথম আলো:
অর্থ পাচারের আলোচনা মানে ব্যাংক খাতের দুর্নীতি ও খেলাপি ঋণ। বর্তমান কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাংকিং খাতের ক্ষত সারাতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। সেগুলো কতটা ফলপ্রসূ হবে বলে মনে করেন?
ইফতেখারুজ্জামান: কর্তৃত্ববাদী শাসনের হাতে জিম্মি থাকা অন্যতম খাত ছিল ব্যাংকিং খাত। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেটি সম্ভব হয়েছে ব্যাংকিং খাতের সর্বোচ্চ রেগুলেটরি অথরিটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনিয়মের কারণে। তারাই ব্যাংকিং খাতে দুর্নীতির সুযোগগুলো করে দিয়েছে। যারা দেশে ঋণখেলাপির সংস্কৃতি চালু করেছে, তাদের শীর্ষ নেতাই কিন্তু দেশের প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা হয়েছিলেন। রাষ্ট্রকাঠামো দখলের হাতিয়ারও তাঁদের হাতে চলে গিয়েছিল। তাঁরাই ঠিক করেছেন ব্যাংকিং খাতে কী নিয়ম হবে। খেলাপি ঋণের জন্য কী নিয়ম হবে, সেটি ঠিক করেছেন ঋণখেলাপিরাই। বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার হিসেবে সেসব ইস্যু করেছে। আমাদের সৌভাগ্যের বিষয়, এখন আমরা একজন যোগ্য ও দক্ষ গভর্নর পেয়েছি। তিনি বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন। তবে সেসবের ফল পেতে সময় লাগবে।
প্রথম আলো:
ত্রুটিপূর্ণ আইনকে দুর্নীতি দমনের বাধা হিসেবে দেখা হয়। যেমন দুর্নীতির দায়ে এক বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড ভোগ করলেও সরকারি চাকরি না যাওয়া, কারাদণ্ড ভোগ করার পরও স্বপদে বহাল থাকা, দুর্নীতির সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার পরও চাকরি যাবে না। এসব বিধিমালা বা আইনের বিষয়ে আপনারা কী ভাবছেন?
ইফতেখারুজ্জামান: দুর্নীতির অভিযোগে সরকারি কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রে পূর্ব অনুমতি ছাড়া আটক করা যাবে না। আবার কর আইনে কালোটাকাকে সাদা করার সুযোগ থাকে। বলে দেওয়া হয়, সেই কালোটাকার বিষয়ে দুদক প্রশ্নও করতে পারবে না। এসব আইন তো বৈষম্যমূলক এবং দুর্নীতি–সহায়ক একটা বিধিমালা। আমরা দেখছি, এখানে কীভাবে সংস্কার আনা যায়। আর আপনি যে শাস্তির কথা বললেন, টিআইবিরই প্রয়াসে জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশলের ওপর ভিত্তি করে শুদ্ধাচার পুরস্কার দেওয়ার প্রথা শুরু হয়েছিল। সেই পুরস্কারগুলো দেওয়ার কথা যাঁরা শুদ্ধাচার করেছেন, ইতিবাচক দৃষ্টান্ত তৈরি করেছেন, তাঁদের। অথচ সে পুরস্কার পেয়েছেন বেনজীর আহমেদের মতো ব্যক্তিরা। ভালো আইন বা নীতিমালাকে খারাপভাবে রূপান্তর করা থেকেও আমাদের সরে আসতে হবে। রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক দুর্বৃত্তায়ন দুর্নীতিকে এমন একটা স্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে গেছে, এটি যেন একটি পেশা। আমলাতন্ত্রে ধরে নেওয়া হয় যে ‘দুর্নীতি করব, কিন্তু চাকরি যাবে না।’ বিভাগীয় শাস্তি হিসেবে বড়জোর আরেক জায়গায় বদলি করা হয়। এর মধ্য দিয়ে দুর্নীতিও এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় বদলি হয়।
প্রথম আলো:
যেকোনো সরকার ক্ষমতায় এলেই বলে সরকারি কর্মকর্তাদের সম্পদের হিসাব দেওয়া হবে। কিন্তু সেটি পরবর্তী সময় আর হয় না। অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষেত্রেও এখন পর্যন্ত আমরা তেমনটি দেখছি কি না?
ইফতেখারুজ্জামান: বাস্তবে হচ্ছে, যেটি সরকার, সেটি আমলাতন্ত্র বা যেটি আমলাতন্ত্র, সেটিই সরকার। রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক দুর্বৃত্তায়ন কিন্তু পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। মূলত ক্ষমতার অপব্যবহারের জন্য। সে কারণে আইনি বাধ্যবাধকতা থাকার পরও সম্পদের হিসাব দিতে গিয়ে এমন পরিস্থিতি আমরা দেখি। এখন অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষেত্রে আমি খোলাখুলিভাবেই বলব, সরকারের দু-একজন ব্যতিক্রম ছাড়া আমলাতন্ত্রের সঙ্গে কাজ করার, আমলাতন্ত্রকে পরিচালনা করার যে অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা, সেটি অন্যদের ক্ষেত্রে বিরল। এর মধ্যে দীর্ঘকালের দলীয়করণের আমলাতন্ত্রে পতনের ফলে আরেকটি আমলাতন্ত্র প্রতিস্থাপিত হয়েছে। সেখানেও কিন্তু দলীয়করণ ঘটছে। যে কারণে পদোন্নতি ও বদলি নিয়ে অসন্তোষও আমরা দেখেছি। এখন এদের ওপরই অন্তর্বর্তী সরকার নির্ভরশীল। ফলে সম্পদের হিসাব দেওয়ার ব্যাপারে তাদের পক্ষে কঠোর অবস্থান নেওয়া কতটা সম্ভব, সেটি দেখার বিষয়।
প্রথম আলো:
ভয়েস অব আমেরিকা বলছে, দেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বেড়েছে। সংবাদমাধ্যমও আওয়ামী লীগ আমলের চেয়ে বেশি স্বাধীনতা ভোগ করছে। আবার কোনো গোষ্ঠী থেকে এমন কর্মসূচিও দেখা যাচ্ছে, যা স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের জন্য কোনো অর্থেই স্বস্তিদায়ক নয়। বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?
ইফতেখারুজ্জামান: নতুন বাংলাদেশে গণমাধ্যম ও কথা বলার স্বাধীনতা আবারও খর্ব হবে, তা কোনোভাবেই আমরা চাই না। কর্তৃত্ববাদী সরকারের সময়ে গণমাধ্যমকে নানা নিপীড়নের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। আবার মিডিয়ার একাংশ যে কর্তৃত্ববাদী সরকারের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছে, তা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। ফলে এখানে তাদের প্রতি প্রতিশোধপরায়ণতার একটি বিষয় আমরা দেখছি। তার অর্থ এই নয়, পুরো মিডিয়াকে দোষী করতে হবে। হত্যা মামলা দেওয়া, ঢালাওভাবে অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড বাতিলের ক্ষেত্রে সরকারের চিন্তার ঘাটতি ছিল বলে আমি মনে করি। আবার আরেকটি বিষয়, ছাত্র–জনতার আন্দোলনের স্বপ্ন সবার জন্য এক হতে পারে; কিন্তু যাঁরা এ স্বপ্ন দেখছেন, তাঁদের সবার এজেন্ডা কিন্তু এক নয়। কারও কারও এজেন্ডা বাস্তবায়নে আবার নির্দিষ্ট কিছু সংবাদমাধ্যম প্রতিষ্ঠানে আক্রমণ আমরা দেখছি, সেটি তাদের নিজস্ব চিন্তা বা কারও প্ররোচনার কারণে। সেসব সংবাদমাধ্যম কর্তৃত্ববাদী সরকারের সময়ও আক্রান্ত হয়েছিল নানাভাবে এবং জুলাই অভ্যুত্থানের সময় জনগণের কাছে সংবাদ ও তথ্য প্রচারে বড় ভূমিকা রেখেছে। এখন তাদের ওপর বাধা আসাটা কোনোভাবে কাম্য নয়। সরকারের উচিত ঘটনা ঘটার সময় অ্যাডহক ভিত্তিতে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে বা তাৎক্ষণিক বক্তব্য না দিয়ে ইঙ্গিত বুঝে সুনির্দিষ্ট কৌশলে আগে থেকেই বিষয়টি মোকাবিলা করা।
প্রথম আলো:
আপনাকে ধন্যবাদ।
ইফতেখারুজ্জামান: আপনাকেও ধন্যবাদ।