
যুগের পর যুগ ফিলিস্তিনে রক্ত ঝরাচ্ছে ইসরাইল। অথচ, একদিন এই ইসরাইল নামের রাষ্ট্রই ছিল না। সেখানে ইউরোপের নির্যাতিত ইহুদিদের ঠাঁই দেয়াই কী আরবদের ভুল ছিল! যার ফলে ১৯৪৮ সালে সৃষ্টি হয় ইসরাইল নামের রাষ্ট্র! তারপর থেকে তারা মুসলিমদের ওপর অব্যাহতভাবে নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ধারাবাহিকভাবে যুদ্ধ হয়েছে। অব্যাহতভাবে সেসব যুদ্ধে মুসলিমদের রক্ত ঝরিয়েছে তারা। অন্যদিকে মুসলিমদের, বিশেষ করে ফিলিস্তিনিদের রাষ্ট্রের অধিকারকে তারা অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছে। রাষ্ট্রের অধিকার চাওয়া মূল ভূখণ্ডের মালিক এসব মুসলিমকে তারা বানিয়ে দিয়েছে তাদের ভাষায় ‘সন্ত্রাসী’। নিজের জন্মভূমি, নিজের দেশের জন্য এত রক্তপাত, এত লড়াই পৃথিবীতে বিরল। কতো মা সন্তান, স্বামী, পরিজন হারিয়েছেন। কতো পিতা স্ত্রী, সন্তান হারিয়েছেন। কতো শিশু এতিম হয়েছে। কতো নিরপরাধ শিশুর রক্তে লাল হয়েছে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইলের হাত- এর কোনো হিসাব নেই। এ হিসাব ইতিহাস কোনোদিন নির্ধারণ করতে পারবে না। তবু আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত যুদ্ধাপরাধী ইসরাইল ও এর প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর লেলিয়ে দেয়া সেনাদের সামনে প্রায় নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিরা, গাজার হামাস যুদ্ধ অব্যাহত রেখেছে। তাদের প্রতি সংহতি জানিয়েছে বাংলাদেশ। এদেশের রাজনৈতিক দল, বিভিন্ন ইসলামী সংগঠন সংহতি জানিয়ে র্যালি করেছে। সে খবর পৌঁছে গেছে আন্তর্জাতিক দুনিয়ায়।
আরব বিশ্বের নেতাদের নিষ্ক্রিয়তায় ধিক্কার জানানো হয়েছে। তাদেরকে উজ্জীবিত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশের মুসলিমপ্রিয় মানুষ। ভিডিওতে গাজার শিশুর ঘাস খাওয়ার ছবি যদি আপনি দেখে থাকেন, তাহলে নিশ্চয়ই আপনার চোখে অশ্রুক্ষরণ হয়েছে। অসহায় রক্তাক্ত শিশু ইসরাইলি সেনার পা জড়িয়ে ধরে ঠক ঠক করে কাঁপছে। এ দৃশ্য নিশ্চয় আপনার চোখ এড়িয়ে যায়নি। এই যে রক্তবাণ- কেন? বিশ্নের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘদিন ধরে চলমান যুদ্ধ এবং সহিংস বিরোধের অন্যতম ফিলিস্তিনি জনগণ এবং ইসরাইলের মধ্যে যুদ্ধ। এর শিকড় কমপক্ষে এক শতাব্দী পেছনে প্রোথিত। ইসরাইল এবং আরব দেশগুলোর মধ্যে ধারাবাহিক যুদ্ধ হয়েছে। ইসরাইলি অবৈধ দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলন বা ইন্তিফাদা হয়েছে। প্রতিশোধ নিতে ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে নৃশংস দমনপীড়ন চালিয়েছে ইসরাইল। ভূমি, সীমান্ত এবং অধিকারের মতো গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক ইস্যুতে এই যুদ্ধ। বর্তমানে এই যুদ্ধ প্রকট আকার ধারণ করেছে ইসরাইল এবং হামাসের মধ্যে। কেন হামাস, তথা ফিলিস্তিন এবং ইসরাইলের মধ্যে এই যুদ্ধ এতদিন ধরে চলছে? এ প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে অনেকটা পেছনে যেতে হবে আমাদেরকে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় মধ্যপ্রাচ্যের অংশ ছিল ফিলিস্তিন। তা ছিল অটোম্যান সাম্রাজ্যের শাসনের অধীনে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় অটোম্যানরা পরাজিত হয়। ফলে ফিলিস্তিন নামের ভূখণ্ড নিয়ন্ত্রণে নেয় বৃটেন। সেখানে তখন অন্য জাতিগোষ্ঠীর পাশাপাশি বসবাস করতেন আরব সংখ্যাগরিষ্ঠরা ও ইহুদি সংখ্যালঘুরা। যুদ্ধে জয়ের পর ফিলিস্তিনে ইহুদিদের একটি ‘নিজস্ব ভূখণ্ড’ প্রতিষ্ঠার নীতিগত সিদ্ধান্তে আসে বৃটেন। এই উদ্যোগ পরিচিত ‘বালফার ডিক্লারেশন’ নামে। বৃটেন এমন সিদ্ধান্ত নেয়ার পর ইহুদি ও আরব জনগোষ্ঠীর মধ্যে উত্তেজনা তীব্র হয়ে ওঠে। ঐতিহাসিকভাবে এই ভূমির সঙ্গে যোগসূত্র ছিল ইহুদিদের। অন্যদিকে ফিলিস্তিনি আরবরাও এই ভূখণ্ড তাদের বলে দাবি করে। তারা বলে, বহু শতাব্দী ধরে এই ভূমির মালিক তারা। ফলে তারা বৃটিশ উদ্যোগের বিরোধিতা করে। এ নিয়ে যখন উত্তেজনা তুঙ্গে ওঠে, তখন বৃটেন প্রতিশ্রুতি দেয় যে, ফিলিস্তিনি আরবদের অধিকার সুরক্ষিত রাখা হবে। কিন্তু ১৯২০-এর দশক এবং ১৯৪০-এর দশকের মধ্যে ফিলিস্তিনের ওই ভূখণ্ডে ইহুদিদের সংখ্যা বেড়ে যায়। ইউরোপে নির্যাতনের শিকার হয়ে অনেক ইহুদি এ সময় উড়ে যায় ফিলিস্তিনের ওই ভূখণ্ডে। হলোকাস্টের সময় ৬০ লাখ ইহুদিকে হত্যা করা হয়। এর ফলে তাদেরকে একটি নিরাপদ আশ্রয় দেয়ার দাবি জোরালো হতে থাকে। এভাবে ১৯৪৭ সাল নাগাদ ফিলিস্তিন ভূখণ্ডের যেখানে ইসরাইল, সেখানে মোট জনসংখ্যার শতকরা ৩০ ভাগের উপরে দাঁড়ায় ইহুদিদের সংখ্যা। তাদের এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৬ লাখ ৩০ হাজার। ১৯৪৭ সালে ইহুদি ও আরবদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান সহিংসতা এবং বৃটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিন ইস্যু ভোটে দেয় জাতিসংঘ। তাতে বলা হয়, ফিলিস্তিনকে ভেঙে ইহুদিদের এবং আরব রাষ্ট্রকে আলাদা করা হবে। আর জেরুজালেম হবে একটি আন্তর্জাতিক শহর। কিন্তু এই প্রস্তাবে কোনো আরব দেশ সমর্থন দেয়নি। তারা যুক্তি দেন যে, এই পরিকল্পনায় ইহুদিদেরকে অধিক পরিমাণ ভূমি দেয়ার কথা বলা হয়েছে, যদিও তাদের জনসংখ্যা অনেক কম। তাদের কথা কানে তোলেনি বৃটেন। তারা এই সমস্যা ১৯৪৮ সালে ১৪ই মে তুলে দেয় জাতিসংঘের হাতে। বৃটিশ শাসন শেষ হওয়ার কয়েক ঘণ্টা আগে ফিলিস্তিনে বসবাসরত ইহুদি নেতারা একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের ঘোষণা দেয়, যার নাম হলো ইসরাইল। পরের বছরই জাতিসংঘ ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়। ফলে আরবদের বুকের উপর চেপে বসে ইহুদিরা।
কিন্তু ইসরাইল নিজেদের স্বাধীনতা ঘোষণা দেয়ার একদিন পরেই তাদের ওপর হামলা চালানো হয়। ৫টি আরব দেশের সেনারা তাদেরকে ঘিরে ফেলে। এই যুদ্ধকে ইসরাইল দাবি করে তাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ হিসেবে। ১৯৪৯ সালের দিকে যুদ্ধ যখন বন্ধ হয়ে আসে, তখন ফিলিস্তিনের অনেক বেশি ভূখণ্ড নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয় ইসরাইল। চুক্তি হয় তাদের মধ্যে। সেই চুক্তি অনুযায়ী গাজা উপত্যকা দখলে নেয় মিশর। পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেম দখলে নেয় জর্ডান। পশ্চিম জেরুজালেম দখলে নেয় ইসরাইল। ইসরাইল যে ভূখণ্ড দখল করে সেখান থেকে প্রায় সাড়ে সাত লাখ ফিলিস্তিনি পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। অথবা তাদেরকে জোর করে গৃহহীন করা হয়। ভূমি থেকে উচ্ছেদ করে ইসরাইল। এর ফলে ওই ফিলিস্তিনিরা পরিণত হন শরণার্থীতে। এই ঘটনাকে আরবিতে ‘নাকবা’ বা বিপর্যয় হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এর পরের বছরগুলোতে মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকার মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলো থেকে হাজার হাজার ইহুদি ইসরাইলে চলে যায় অথবা তাদেরকে ওইসব দেশ থেকে বহিষ্কার করা হয়। তাদের বেশির ভাগেরই ঠিকানা হয় ইসরাইল।
১৯৬৭ সালে মধ্যপ্রাচ্যে ভয়াবহ এক যুদ্ধ হয়। এটা ‘সিক্স ডে ওয়ার’ বা ছয়দিনের যুদ্ধ নামে পরিচিত। এর ফলে মধ্যপ্রাচ্যের সীমানায় ব্যাপক পরিবর্তন হয়। ফিলিস্তিনের জন্য বয়ে আনে বিরাট পরিণতি। এই যুদ্ধে ইসরাইলের বিরুদ্ধে লড়াই করে মিশর, সিরিয়া ও জর্ডান। ইসরাইল আগে থেকেই আতঙ্কে ছিল যে মিশর ও সিরিয়া তাদের ওপর হামলা করতে পারে। এ জন্য মিশরের বিমান বাহিনীর ওপর হামলা চালায় ইসরাইল। এ কারণে শুরু হয় ১৯৬৭ সালের ওই যুদ্ধ। যুদ্ধ যখন শেষ হয়ে আসে, ততক্ষণে সিনাই পেনিনসুলা এবং মিশরের কাছ থেকে গাজাকে তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিয়েছে ইসরাইল। সিরিয়ার কাছ থেকে গোলান উপত্যকার বেশির ভাগ অংশ দখল করেছে। জর্ডানের কাছ থেকে দখল করেছে পূর্ব জেরুজালেম ও পশ্চিমতীর। এ কারণে পশ্চিমতীর, গাজা এবং পূর্ব জেরুজালেমের প্রায় দশ লাখ ফিলিস্তিনি চলে যায় ইসরাইলের নিয়ন্ত্রণে। এসব অঞ্চল সেই যে ইসরাইল দখল করেছে তা আর তাদের কাছ থেকে ফেরত পায়নি মুসলিমরা। তা এখনো ইসরাইলের দখলে আছে। এরই মধ্যে ফিলিস্তিনিরা স্বাধীনতা দাবি করেছে। তাদের পক্ষে জাতিসংঘ। কিন্তু পশ্চিমা শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেনের ভেটোর কারণে ফিলিস্তিন স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছে না। এই দাবিতেই হামাস লড়াই করছে। স্বদেশের স্বাধীনতা, নিজেদের একটি রাষ্ট্রের পক্ষে লড়াই করার কারণে তাদেরকে পশ্চিমা বিশ্ব ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে অভিহিত করছে।
১৯৭৯ সালে মিশরের সঙ্গে একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করে ইসরাইল। তারা সিনাই পেনিনসুলাকে ফেরত দেয়। অন্যদিকে পূর্ব জেরুজালেম এবং গোলান উপত্যকায় তাদের থাবা বিস্তার করে। এ দুটি অংশকে নিজেদের বানিয়ে ফেলে ইসরাইল। তবে আজ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এসব এলাকাকে ইসরাইলের বলে স্বীকৃতি দেয়নি।
পশ্চিমতীর: ইসরাইল এবং জর্ডান নদীর মধ্যবর্তী অংশ পশ্চিমতীর নামে পরিচিত। সেখানে বসবাস করেন প্রায় ত্রিশ লাখ ফিলিস্তিনি। পূর্ব জেরুজালেম এবং গাজার সঙ্গে এ অংশ ব্যাপকভাবে ‘দখলীকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড’ হিসেবে পরিচিত। এ অঞ্চলে ইসরাইলি উপস্থিতির বিরুদ্ধে সবসময়ই বিরোধিতা করে এসেছেন ফিলিস্তিনিরা। তাদের দাবি ভবিষ্যৎ স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের অংশ হতে হবে ওইসব ভূখণ্ড। তাদের এই ধারণাকে সমর্থন করেন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বড় একটি অংশ। কিন্তু পশ্চিমতীরের পুরো নিয়ন্ত্রণ ইসরাইল ধরে রেখেছে। তবে ১৯৯০-এর দশক থেকে ফিলিস্তিন সরকার, যা প্যালেস্টাইনিয়ান অথরিটি নামে পরিচিত, তারা এর শহরগুলোর বেশির ভাগ অংশ পরিচালনা করছে। পশ্চিমতীর এবং পূর্ব জেরুজালেমে আছে প্রায় ১৫০টি ইসরাইলি বসতি। তাতে বসবাস করে প্রায় সাত লাখ ইহুদি। দখল করা ভূখণ্ডে এসব বসতি স্থাপনকারীদের সরিয়ে নেয়ার দাবি জানায় ফিলিস্তিন। তাদেরকে আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে অবৈধ বসতি স্থাপনকারী হিসেবে দেখে তারা। তবে তাদের এই দাবির বিরোধিতা করে ইসরাইল সরকার। তারা বলে, বৃহৎ এই বসতি হলো স্থায়ী। সেখানে যেসব বসতি রয়েছে তাদের বসবাসের ঐতিহাসিক অধিকার আছে। পক্ষান্তরে তারা ফিলিস্তিনিদের নিজস্ব রাষ্ট্রের অধিকারকে অস্বীকৃতি জানায়। যুক্তি দেখায়, পশ্চিমতীর হলো ইসরাইলিদের হোমল্যান্ড বা জন্মভূমি। ২০২২ সালে ক্ষমতায় আসার পর এসব স্থানে বসতি সম্প্রসারণের পরিকল্পনা ঘোষণা করে ইসরাইলি সরকার। তারা বলেন, ফিলিস্তিন রাষ্ট্র সৃষ্টি করা হলে তা হবে ইসরাইলের নিরাপত্তার প্রতি হুমকি।
২০২৪ সালে জাতিসংঘের সর্বোচ্চ আদালত ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস (আইসিজে) তার রায়ে বলে, দখলীকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরাইলিদের অব্যাহত উপস্থিতি অবৈধ। সব বসতি প্রত্যাহার করে নিতে হবে ইসরাইলকে। একই সঙ্গে তারা যেটা ঘটিয়েছে, তা বর্ণবাদ ও জাতিবিদ্বেষ বিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তির লঙ্ঘন।
জেরুজালেম নিয়ে বিরোধ: জেরুজালেমকে নিজেদের রাজধানী বলে দাবি করে ফিলিস্তিন এবং ইসরাইল উভয়পক্ষই। এরই মধ্যে পশ্চিম জেরুজালেম নিয়ন্ত্রণ করে ইসরাইল। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে তারা পূর্ব জেরুজালেম দখল করে। পরে তারা পুরো জেরুজালেমকে তাদের স্থায়ী রাজধানী ঘোষণা করে। জানিয়ে দেয়, জেরুজালেমকে ভাগ করা যাবে না। অন্যদিকে ভবিষ্যৎ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে পূর্ব জেরুজালেমকে দাবি করেছে ফিলিস্তিনিরা। পূর্ব জেরুজালেমে যারা বসবাস করেন তার বেশির ভাগই ফিলিস্তিনি। তার মধ্যে খুবই কম সংখ্যক সংখ্যালঘু ইসরাইলি নাগরিকত্ব নিয়েছে। পবিত্র জেরুজালেমই ফিলিস্তিন এবং ইসরাইলের সংঘাতের মূলে। পূর্ব জেরুজালেম মুসলিমদের কাছে তৃতীয় সর্বোচ্চ পবিত্র স্থান। কারণ, এখানেই রয়েছে পবিত্র আল আকসা মসজিদ বা হারাম আল শরীফ। অন্যদিকে আছে ইহুদিদের টেম্পল মাউন্ট। ইসরাইলিরা পূর্ব জেরুজালেমে যে জায়গা দখল করে নিয়েছে তা ফিলিস্তিনিদের বলে মত দিয়েছে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক বেশির ভাগ সংস্থা।
গাজায় কী ঘটেছে: ইসরাইল, মিশর ও ভূমধ্যসাগর দিয়ে বেষ্টিত একটি ছোট্ট ভূখণ্ডই গাজা উপত্যকা। এর দৈর্ঘ্য ৪১ কিলোমিটার বা ২৫ মাইল। প্রস্থ ১০ কিলোমিটার। এখানে বসবাস করেন প্রায় ২৩ লাখ মানুষ। একে বলা হয় বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার অন্যতম। হামাস ও ইসরাইলের মধ্যে যুদ্ধ শুরুর অনেক আগে থেকেই বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বেকারত্বের হারের অন্যতম গাজা। সেখানে বেশির ভাগ মানুষই বসবাস করেন দারিদ্র্যসীমার নিচে। তারা বেঁচে থাকেন বিদেশি সহায়তার ওপর নির্ভর করে। ১৯৪৮ সালে মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধের সময় যখন গাজা মিশরের অধীনে ছিল, তখনই গাজার সীমানা নির্ধারণ হয়। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে গাজা থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয় মিশরকে। তখন তা দখল করে নেয় ইসরাইল। সেখানে তারা নির্মাণ করে বসতি। গাজায় বসবাসকারী জনগণকে সামরিক শাসনের অধীনে রাখে। ২০০৫ সালে গাজা থেকে নিজেদের সেনা এবং বসতি স্বীয় সিদ্ধান্তে প্রত্যাহার করে নেয় ইসরাইল। তবে অভিন্ন সীমান্ত, আকাশসীমা, সমুদ্র উপকূলে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখে। একই সঙ্গে গাজায় জনগণ ও পণ্য চলাচল নিয়ন্ত্রণ করে ইসরাইল। এখনো গাজাকে ইসরাইলের দখল করা ভূখণ্ড বলে মনে করে জাতিসংঘ। ফিলিস্তিনে ২০০৬ সালের নির্বাচনে জয় পায় যোদ্ধাগোষ্ঠী হামাস। পরের বছরে তীব্র লড়াইয়ের পর গাজা থেকে প্রতিদ্বন্দ্বীদের বের করে দেয় তারা। এর জবাবে অবরোধ আরোপ করে ইসরাইল ও মিশর। অন্যদিকে গাজায় কী প্রবেশ করবে, কী প্রবেশ করবে না তার বেশির ভাগই নিয়ন্ত্রণ করে ইসরাইল। পরের বছরগুলোতে হামাস ও ইসরাইলের মধ্যে বেশ কয়েকটি বড় যুদ্ধ হয়েছে। এর মধ্যে আছে ২০০৮-০৯ সময়ের যুদ্ধ, ২০১২ সালের যুদ্ধ এবং ২০১৪ সালের যুদ্ধ। দুই পক্ষের মধ্যে বড় একটি যুদ্ধ ১১ দিন পরে ২০২১ সালের মে মাসে যুদ্ধবিরতি চুক্তির মধ্যদিয়ে শেষ হয়। প্রতিটি যুদ্ধেই উভয় পক্ষে মানুষ নিহত হন। এর বেশির ভাগই ফিলিস্তিনের গাজায়। ২০২৩ সালের ৭ই অক্টোবর গাজায় ভয়াবহ ড্রোন হামলা চালায় হামাস। এতে প্রায় ১২০০ ইসরাইলি নিহত হয়। তারা জিম্মি করে কমপক্ষে ২৫০ জনকে। এর প্রতিশোধ নিতে গাজায় ভয়াবহ সামরিক হামলা চালায় ইসরাইলি সেনাবাহিনী। তাতে এ পর্যন্ত কমপক্ষে ৫১ হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন। এর বেশির ভাগই নারী ও শিশু। ৭ই অক্টোবর হামলার এক বছর পূর্ণ হওয়ার কয়েকদিন আগে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক এজেন্সিগুলো গাজায় মানুষের দুর্ভোগ ও মানবিক বিপর্যয় বন্ধের দাবি জানিয়ে একটি ঘোষণায় স্বাক্ষর করে। ১৫ মাসের যুদ্ধের পরে ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে যুদ্ধ স্থগিতের একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে রাজি হয় হামাস ও ইসরাইল। বিনিময়ে উভয় পক্ষ বন্দি ও জিম্মিদের মুক্তি দেয়। তারপর থেকে যুদ্ধবিরতি চুক্তি কার্যকর করা নিয়ে বিভিন্ন দেন-দরবার চলছে। সম্প্রতি একটি চুক্তির প্রথম মেয়াদ শেষে ১৮ই মার্চ থেকে গাজায় নৃশংস হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরাইল। প্রতিদিনই সেখানে লাশ পড়ছে।
ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি: জাতিসংঘের ১৯৩টি সদস্য দেশের মধ্যে ১৪৩টি দেশ জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে ফিলিস্তিনকে জাতিসংঘের পূর্ণাঙ্গ সদস্যপদ দেয়ার পক্ষে ভোট দেয় ২০২৪ সালের মে মাসে। জাতিসংঘে তাদের পরিচয় হয় ‘স্টেট অব প্যালেস্টাইন’। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের মর্যাদা হয় ‘পার্মানেন্ট অবজার্ভার স্টেট’ বা পর্যবেক্ষক দেশ। জাতিসংঘে তাদের আসন থাকবে। কিন্তু তারা ভোট দিতে পারবে না। যুক্তরাষ্ট্র সহ কিছু ইউরোপিয়ান দেশ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেয় না। তারা বলে, মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘমেয়াদি এই যুদ্ধের একটি রাজনৈতিক সমাধান হলে তবেই এই স্বীকৃতি দেবে। ২০১৪ সালে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেয়ার পক্ষে ভোট দেন বৃটিশ এমপিরা। কিন্তু সরকার সেটা করেনি। ২০২১ সালে তখনকার রক্ষণশীল বা কনজারভেটিভ সরকার বলে- আমাদের পছন্দের সময়ে এবং শান্তির পক্ষে যখন উত্তম ব্যবস্থা হবে ফিলিস্তিনকে তখন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেবে বৃটেন। অন্যদিকে পশ্চিম তীরে নিজেদের ঐতিহাসিক অধিকার আছে বলে দাবি করে ইসরাইল। একই সঙ্গে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের বিরোধিতা করে তারা। তাদের যুক্তি, ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিলে তা হবে অগ্রহণযোগ্য পর্যায়ের এক হুমকি।
ফিলিস্তিনি শরণার্থী: জাতিসংঘের নিবন্ধন অনুযায়ী প্রায় ৫৯ লাখ ফিলিস্তিনি শরণার্থী রয়েছেন। ১৯৪৮ থেকে ১৯৪৯ সালের মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের সময় ফিলিস্তিনিদের পূর্ব পুরুষদের অনেকে দেশ ছেড়ে যান অথবা তাদেরকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়। তাদের বেশির ভাগ বসবাস করেন জর্ডান, গাজা উপত্যকা, পশ্চিমতীর, সিরিয়া ও লেবাননে। এসব শরণার্থীকে দেশে ফেরার দাবি জানান ফিলিস্তিনিরা। কিন্তু এ অধিকারকে প্রত্যাখ্যান করে ইসরাইল। ফিলিস্তিনে শরণার্থী বিষয়ক জাতিসংঘের এজেন্সির সমালোচনা করে ইসরাইল। তারা বলেন, জাতিসংঘ এসব শরণার্থীকে পর্যায়ক্রমিক প্রজন্মের মধ্যে শরণার্থী মর্যাদা দিয়ে যাচ্ছে।
দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান চেষ্টা: ইসরাইল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে শান্তি স্থাপনে দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানকে সমর্থন করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। এই প্রস্তাবে পশ্চিম তীর, গাজাকে নিয়ে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের কথা বলা হয়েছে। যার রাজধানী হবে পূর্ব জেরুজালেম। তারা অবস্থান করবে ইসরাইলের পাশাপাশি। তবে এই সমাধান প্রচেষ্টা প্রত্যাখ্যান করে ইসরাইল। তারা বলে, বসতি স্থাপনের যেকোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসতে হবে ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে সমঝোতায়। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের দাবি পূর্ব শর্ত হতে পারে না। দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান প্রক্রিয়াকে সমর্থন করে প্যালেস্টাইনিয়ান অথরিটি। কিন্তু হামাস তা সমর্থন করে না। কারণ, তারা ইসরাইলের অস্তিত্বের বিরোধিতা করে। হামাস বলে, ১৯৬৭ সালের মূল সীমান্তের ওপর ভিত্তি করে একটি অন্তর্বর্তীকালীন রাষ্ট্র তারা মানতে পারে। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে ইসরাইলকে মানবে না, যদি তারা শরণার্থীদেরকে দেশে ফেরার অধিকার প্রত্যাখ্যান করে। এর আগে এই দুই পক্ষের যুদ্ধের ইতি ঘটেছিল। এ লক্ষ্যে দুই দেশের নেতারা ১৯৯৩ সালে অসলো পিস অ্যাকর্ড স্বাক্ষর করেন। এটাকে শান্তি সংলাপের একটি মূল কাঠামো হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু একে অন্যকে দোষারোপ করার কারণে সেই সংলাপ শুরুতেই ভেঙে যায়।
(সূত্র: বিবিসি ও ইন্টারনেট)