ফের ভাঙলো জাতীয় পার্টি

আরেকবার ভাঙলো জাতীয় পার্টি। এনিয়ে আটবার ভাগ হলো দলটি। ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদের নেতৃত্বে গতকাল নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদেরকে ছাড়াই অনুষ্ঠিত হয় কাউন্সিল। যাতে সভাপতি ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার হয়েছেন মহাসচিব। বহুল চর্চিত গঠনতন্ত্রের ২০ (১) ক ধারাটি বাতিল হয়েছে কাউন্সিলে। দেয়া হয়েছে ঐক্যের ডাক। কাউন্সিল করে নতুন কমিটি গঠন করা হলেও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের নেতৃত্বাধীন অংশ বিভ্রান্ত না হওয়ার বার্তা দিয়েছে। কাদের বিরোধীদের এই কাউন্সিল এবং কমিটি গঠনের মাধ্যমে দলটি দৃশ্যত আরও দু’টি অংশে বিভক্ত হয়ে পড়েছে।
১৯৮৬ সালে সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে দলটি। নির্বাচন কমিশনে যুক্ত নামের সঙ্গে সবথেকে বেশি নাম জাতীয় পার্টি। এর সঙ্গে ব্রাকেটবন্দি রয়েছে নেতাদের নাম। এরশাদের জীবদ্দশায় পাঁচবার এবং তার মৃত্যুর পর তিনবার এভাবে ভাগ হয় জাতীয় পার্টি।
১৯৯৬ সালের নির্বাচনের পরে আনোয়ার হোসেন মঞ্জু আলাদা হয়ে যান। তিনি জাতীয় পার্টি (জেপি) গঠন করেন। দলটির মহাসচিবের দায়িত্বে রয়েছেন শেখ শহীদুল ইসলাম, প্রতীক বাইসাইকেল। ২০০১ সালের নির্বাচনে আগে নাজিউর রহমান মঞ্জুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি) নামে দল গঠন করে। এই অংশটির নেতৃত্বে এখন রয়েছেন আন্দালিব রহমান পার্থ, মহাসচিব আব্দুল মতিন সাউদ। প্রতীক গরুর গাড়ি। আবার এই বিজেপি দুই ভাগ হয়ে যায়। ব্রাকেটবন্দি হয় ডা. এম এ মতিনের নামে। প্রতীক কাঁঠাল। ২০১৩ সালে এরশাদের পুরোনো রাজনৈতিক সহকর্মী কাজী জাফর আহমেদ দল ভেঙে আলাদা হন। দলটির চেয়ারম্যান ও মহাসচিব বর্তমানে ফজলে রাব্বি চৌধুরী ও মোস্তফা জামাল হায়দার, প্রতীক মোটরগাড়ি।
কাজী জাফরের দল ভেঙে জাতীয় পার্টি পুনর্গঠনের ঘোষণা দিয়েছিলেন এরশাদের সাবেক স্ত্রী বিদিশা সিদ্দিক। যদিও তা আলোর মুখ দেখেনি। ২৪-এর নির্বাচনে এরশাদপত্নী রওশন এরশাদের নেতৃত্বে দলটিতে ভাঙন হয়। রওশনের নেতৃত্বে আয়োজিত কাউন্সিলে তিনি চেয়ারম্যান ও কাজী মামুনুর রশীদ মাহসচিবের দায়িত্ব পান। এ ছাড়াও রয়েছে তৃণমূল জাতীয় পার্টি। পার্টির চেয়ারম্যান ড. আব্দুল্লাহ আল নাসের ও মহাসচিব শামীম ইশতিয়াক চৌধুরী। এদিকে, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের দায়িত্বে রয়েছেন এরশাদের ভাই জিএম কাদের ও মহাসচিব ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী। প্রতীক লাঙ্গল।
গতকাল রাজধানীর একটি কমিউনিটি সেন্টারে জিএম কাদের বিরোধীদের ‘দশম জাতীয় কাউন্সিল’ অনুষ্ঠিত হয়। কাউন্সিলে কাজী ফিরোজ রশিদকে সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান ও মুজিবুল হক চুন্নু নির্বাহী চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এতে ৩ সদস্যের একটি নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়। আহ্বায়ক মো. জহিরুল ইসলাম, অন্য দুই সদস্য আল মাহমুদ, মো. আরিফুর রহমান খান। এ সময় কণ্ঠভোটে গঠনতন্ত্রের ২০ (১) ক ধারা বাতিল করা হয়। যে ক্ষমতাবলে চেয়ারম্যান যেকোনো নেতাকর্মীকে কারণ দর্শানোর নোটিশ ছাড়াই বহিষ্কার করতে পারতেন। নির্বাচিত কমিটি ১৫ দিনের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের ঘোষণা দেন। সকালে জাতীয় ও দলীয় সংগীত পরিবেশনের মধ্যদিয়ে কাউন্সিলের উদ্বোধন করা হয়। জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন জাতীয় পার্টির ‘ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান’ ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও দলীয় পতাকা উত্তোলন করেন মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু।
প্রথম অধিবেশনের উদ্বোধনী আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। স্বাগত বক্তব্য রাখেন এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার। সাংগঠনিক রিপোর্ট পেশ করেন মুজিবুল হক চুন্নু। প্রধান অতিথির বক্তব্যে জাতীয় পার্টির (জেপি) চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বলেন, মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে এই দেশ সৃষ্টি হয়েছে। অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে আমাদের দেশকে একটা অবস্থানে নিয়ে এসেছিলাম। আজকে সবাই সব কথা বলে, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ-স্বাধীনতার কথা কেউ বলে না। এখন সরকার বলছে, সংস্কার করতে হবে। সংস্কার কি আমরা করিনি। শিক্ষানীতি, ঔষধনীতি, উপজেলা পদ্ধতি এসবই সংস্কারের অংশ ছিল। এখন সংস্কারের জন্য বিদেশ থেকে লোক ভাড়া করে আনতে হয়। তারা কীভাবে সংস্কার করবেন? তারা সংস্কারের প্রস্তাবনা দিতে পারে। কিন্তু তা বাস্তবায়ন করতে হলে নির্বাচিত সংসদ লাগবে।
নির্বাচনের বিষয়ে তিনি বলেন, আদৌ নির্বাচন হবে কিনা জানি না। তাছাড়া দেশে এখন যে পরিবেশ বিরাজ করছে তাতে নির্বাচনের কি দরকার? বড় দুই দলের মধ্যে আসন ভাগাভাগি করে নিলে নির্বাচনের খরচবাবদ দুই হাজার কোটি টাকা বেঁচে যায়। সারা দেশে দখলবাজি চলছে, বাড়ি দখল-দোকান দখল, হাট-বাজার দখল, সব জায়গায় দখলবাজি হচ্ছে। কোনো কিছুতেই নিয়ম কানুনের বালাই নেই। এই সব বন্ধ করতে সরকারের দৃশ্যমান উদ্যোগও চোখে পড়ছে না।
সভাপতির বক্তব্যে ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, জিএম কাদের কাউন্সিল করলেন না, কারণ পদ হারানোর ভয়। ৪০ বছর রাজনীতি করার পর আমার সদস্যপদ বাতিল করা হলো। এক ব্যক্তির বিজনেস, আমরা দলকে হতে দেবো না। আওয়ামী লীগ আমলে হওয়া নির্বাচনে অংশ নেয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা কোনো অন্যায় করি নাই। সরকারকে প্রতিহত করতেও হলে সংসদে যেতে হয়। এরপরও বলবো যদি জনগণ মনে করে অন্যায় হয়েছে আমরা নিঃশর্ত ক্ষমা চাই।
বিএনপিকে উদ্দেশ্য করে বলেন, আপনারা আওয়ামী লীগ আমলে হওয়া নির্বাচনকে বৈধতা দিতে আন্দোলন করেছেন। চট্টগ্রামে বৈধতা দিয়েও দিয়েছেন। স্ববিরোধী অবস্থান ত্যাগ করার আহ্বান জানান তিনি। স্বাগত বক্তব্যে রুহুল আমিন হাওলাদার বলেন, জাতীয় পার্টিকে আমরা নিয়ে যাবো সাধারণ মানুষের কাছে। ফিরিয়ে দিবো তৃণমূলের মর্যাদা। পল্লীবন্ধু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের গড়া জাতীয় পার্টি কারও একক সম্পত্তি নয়, এই পার্টি জনগণের আশা ও অধিকার রক্ষার আন্দোলনে রাজপথে থাকবে। আজ থেকে জাতীয় পার্টি কোনো একক নেতৃত্বে চলবে না।
আওয়ামী লীগের আমলে নির্বাচনে অংশ নেয়ায় দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চান জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু। তিনি বলেন, আমরা দলীয়ভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে কোনো বেআইনি কাজ করিনি। যদি নৈতিকভাবে কোনো ভুল হয়ে থাকে, কোনো ভ্রান্তি হয়ে থাকে তাহলে এই কাউন্সিলে দাঁড়িয়ে জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে দেশবাসীর কাছে আমরা নিঃশর্ত ক্ষমা চাই।
কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, ২৪ সালে নির্বাচনের আগে জিএম কাদেরকে বললাম, নির্বাচনে যাবেন না, গেলে জাতীয় বেইমান হবেন। তিনি বললেন, আমি যাবো না। পরে দেখি উনি গেলেন। আমরা ক্ষমা চাই। ছাত্ররা বিপ্লব করেছে। তারা বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল। এই আন্দোলন সবাই করেছে সব দল। এখন নির্বাচন হলে দিনের ভোট দিনেই হবে। কিন্তু ভোট সব এক বাক্সে যাবে। তারেক রহমানকে বলতে চাই, আওয়ামী লীগের ভুলগুলো করবেন না। মানুষ শান্তিতে বসবাস করতে পারছে না। আগামীতে প্রধানমন্ত্রী হবেন কিন্তু আপনার কথা দলের নেতারা শোনেন না। শুধু বহিষ্কার করলে হবে না। দলকে আপনার কমান্ডের মধ্যে আনতে হবে।
আরও বক্তব্য রাখেন কো-চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, প্রেসিডিয়াম সদস্য সাহিদুর রহমান টেপা, শফিকুল ইসলাম সেন্টু, এটিইউ তাজ রহমান, সোলায়মান আলম শেঠ, নাসরিন জাহান রতনা, নাজমা আকতার, লিয়াকত হোসেন খোকা, মোস্তফা আল মাহমুদ, মাসরুর মওলা, জসিম উদ্দিন ভূঁইয়া, আরিফুর রহমান, নুরুল ইসলাম মিলন, জিয়াউল হক মৃধা, খান ইসরাফিল খোকনসহ বিভিন্ন জেলা কমিটির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকরা। কাউন্সিলে সংহতি জানিয়ে বক্তব্য রাখেন- জাতীয় পার্টি (জেপি) মহাসচিব শেখ শহিদুল ইসলাম, জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর) প্রেসিডিয়াম সদস্য দিদারুল আলম দিদার, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (মতিন) মহাসচিব জাফর আহমেদ জয় প্রমুখ।
অন্যদিকে, শনিবার এক অনুষ্ঠানে জিএম কাদেরের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টির মহাসচিব ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, ইতিহাস বলে, মূল স্রোতের বাইরে গিয়ে যারা জাতীয় পার্টিকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে চেয়েছে, তারাই নিশ্চিহ্ন হয়েছেন। জাতীয় পার্টির বিরুদ্ধে সকল ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে দেবে পল্লীবন্ধু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ও জিএম কাদেরের অনুসারীরা। কোনো ষড়যন্ত্রে বিভ্রান্ত না হয়ে ঐক্যবদ্ধ থাকতে নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বানও জানান তিনি।